

বৃহস্পতিবার ● ১১ এপ্রিল ২০২৪
প্রথম পাতা » অনুপ্রেরণা (গল্প) » ঈদের শপিং
ঈদের শপিং
ঈদের শপিং করব বাবা সেই ১৫ রমজান থেকে ঘুরাইতেছে টাকা আজ না কাল, কাল না পরশু।
যাও আজ দিলো, ঈদের কেনাকাটার জন্য মাত্র ৩ হাজার ৫০০ টাকা দিয়েছে।এই টাকায় কি কেনা কাটা করবো…? তাই টাকা গুলা টেবিলে রেখে চলে এসেছি।
আমার পরিবারটা মধ্যবিত্ত।সব সময় হিসেব করে চলতে হবে।একটুও বাড়তি খরচ করলে মাসের শেষে না খেয়ে থাকতে হবে,বাবা একটা চাকরী করে সিকুরিটির, বেতন পায় ১০ হাজার।এর পর রাতের বেলা বিভিন্ন বাজারে ঔষধ বিক্রয় করেন। সব মিলিয়ে হাজার ২০ এক টাকা আয় আমাদের,তারমধ্যে বাসা ভাড়া দিতে হয় ৮ হাজার টাকা এবার ১২ হাজার টাকায় পুরা মাস।
আজকালকার যুগে ২০ হাজার টাকায় তো এক সপ্তাহও চলা কঠিন।অথচ আমাদের চলতে হয় সারা মাস।মা ও বসে নেই টুকি টাকি হাতের কাজ করে মেশিনে বাসায়।
তা যাই হোক,আমি আমার জীবনটাকে কখনোই ভালোবাসি না।কারন এই হিসেব করে চলা জীবন আমার কখনই পছন্দ না।ঈদের সময় ভেবেছিলাম একটা ভাল মোবাইল কিনবো।অথচ বাবা দিয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৫০০ টাকা ।এতে তো শুধু জামা প্যান্ট কিনবো না কি মোবাইল।
বাবা পরে আরো ৫০০ টাকা বাড়িয়ে পুরো টাকাটা আমার টেবিলের উপর রেখে যায়।আমি টাকাগুলো নিয়ে কতগুলো কথা শুনিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই!
প্রচন্ড রাগ হচ্ছে! ফ্রেন্ড সার্কেলে কিভাবে মুখ দেখাবো ভেবে পাচ্ছি না।ওদের বলেছিলাম ভাল মোবাইল কিনবো,সেলফি তোলতে গেলে মোবাইল চাইতে হয় তাদের কাছে,তা আর হলো না।
পাড়ার পর্দা দেয়া দোকানটায় গিয়ে একটা গোল্ডলিফ ধরাই, কিছু ভালো লাগছে না।দু’টান দিয়ে সেটাও ছুড়ে ফেলি।রিক্সা ডাক দিয়ে বাজারের দিকে যেতে বলি! ওখানে একটা ফ্রেন্ডের দোকান আছে।শুধু শার্ট বিক্রি করে!দেখি ওর কাছে ভালো কোনো শার্ট আছে কি না!
যেতে যেতে রিক্সাটা জ্যামে আটকে যাই জিসিতে ।এমনিতেই মেজাজ খারাপ তার উপর পচন্ড গরম।
তারমধ্যে দেখি ৬/৭ বছরের মতো হবে এমন একটা ছেলে আমার হাত ধরে টানছে, হাতে কতগুলো পএিকা
ভাইয়া,ভাইয়া একটা পেপার নিবেন? মাত্র ১০ টাকা!
-না…রে!
-নেন না ভাইয়া! একটা পেপার কত খবর এখানে।
-আহা! লাগবে না তো।যাচ্ছি মার্কেট,তোর পেপার নিয়ে কি করবো ?আর মোবাইলে নিউজ পরি এখন।
-ভাইয়া,একটা জামা কিনবো ইদের জন্য! নেন না ভাইয়া!
বেশ মায়া লাগলো।তারপর ২টা পেপার নিলাম ২০ টাকা দিয়ে নিয়ে, রিক্সাওয়ালা মামাকে বললাম তাড়াতাড়ি চালাতে!গরমে মেজাজটা আরো গরম হয়ে যাচ্ছে।
সেন্টাল প্লাজার নিচে,পার্কিং এর একটু পিছনে গলির ভিথরে ফ্রেন্ড এর দোকানে গিয়ে দেখি,ফ্রেন্ড নেই।ওয়েট করতে হবে! বসে পড়লাম,ফোনটা বের করে ফেসবুকে ঠুকলাম।দেখি আমার অন্য ফ্রেন্ডরা বড় বড় শপিং মলের চেক-ইন দিচ্ছে! এগুলো দেখে মেজাজটা আরো গরম হয়ে গেলো!ফোনটা পকেটে রেখে পেপার পরছি।
একটু পর ফ্রেন্ড আসে,ওর কাছে শার্ট দেখতে চাইলাম! নতুন কিছু শার্ট এসেছে।সেগুলো দেখছিলাম!
হঠাৎ ঘাড়টা ঘোরাতে গিয়ে দেখি সেই ছেলেটা দোকানের বাইরে দাড়িয়ে তার পকেটের টাকা হিসেব করছে কত টাকা হলো ওখানে।
আর গ্লাসের বাইরে থেকে ভিতরে ঝুলিয়ে রাখা পাঞ্জবী দেখছে।কিন্তু আমি অবাক হচ্ছিলাম এটা ভেবে যে,ছেলে এই দোকানের সামনে কি করছে।এখানে তো শুধু ছেলেদের শার্ট!
হয়তো ভুলে চলে এসেছে,বুঝতে পারেনি।আমি আবার শার্ট দেখতে শুরু করি।একটু পর দেখি দোকানের এক কর্মচারী তাকে তাড়িয়ে দিলো,
আমি শার্টগুলো রেখে বাইরে বের হই।
দেখি ছেলেটা খুব করে রাগারাগি করছে।
-এই পুলা,প্রত্যেকদিন তুই এই জায়গা আইসা দাড়ায় থাকিস ক্যান? যেদিন টাকা নিয়ে আসতে পারবি সেদিন আসবি যা !
-কিন্তু, ততদিনে যদি ওই জামাটা বিক্রি হয়ে যায়? আমার তো ওটাই পছন্দ হইছে!
-হলে হইবো,এখন যা ভাগ।তোরে যেনো আর না দেখি এখানে!
কর্মচারীর কথায় কষ্ট পেয়ে ছেলেটা চলে যাচ্ছিলো।আমি ডাক দিয়ে জানতে চাইলাম,
-তুমি না বললে জামা কিনবে,এখানে তো সব ছেলেদের কাপড়।
-আমি একটা পাঞ্জবী কিনবো।ওই যে দেখতে ছেননা ঝুলানো আছে লাল ,ওই পাঞ্জবী কিনবো।
-কার জন্য..?
-আমার বাবার জন্য!
-বাবার জন্য..? তুমি এতটুকু একটা ছেলে,
বাবার জন্য শার্ট কিনবে..?
-আসলে ৬ মাস আগে আব্বা রিক্সা চালাতে গিয়ে ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করে পায়ে আঘাত পায়! কাজে যাইতে পারে না।মা মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালায়!
প্রতিবছর আব্বা আমার জন্য নতুন জামা কিনে আনতো।কত খাবার কিনে আনতো।কিন্তু এবার আব্বা ঘর থেকেই বের হতে পারে নাই।তাই ভাবছি এবার আমি ডেইলি পেপার বিক্রি করে যা লাভ হয়,তা দিয়ে এই পাঞ্জাবী কিনে দিবো।আব্বার হাসিমুখ দেখলে আমারও খুব ভালো লাগে।
ছেলেটার কথাগুলো শুনে আমার চোখের কি হলো জানি না,শুধু ভিজেই যাচ্ছে।এতটা কান্না বোধহয় আমার আগে কখনো আসেনি।কি বলবো বা করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।স্তম্ভিত হয়ে বসে আছি! ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলাম।এত ছোট বাচ্চা একটা ছেলে এত কিছু বোঝে অথচ আমি এত বড় হয়েও ইচ্ছামতো টাকা না দেবার জন্য বাবার মুখের উপর কত কথা বলেছি।
খুব অমানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে।নিজের জন্য,নিজের স্টাটাস বজায় রাখার জন্য দামী দামী জিনিস কিনেছি সব সময়।অথচ কখনো ভেবেই দেখিনি একটা মানুষ
৫ বছর ধরে একই পাঞ্জাবী পরে ঈদ কাটিয়ে দিচ্ছে!
ঈদের আগের দিন মা ধুয়ে দিতো বাবা সেটা আয়রন করে পরতো।ঈদ উপলক্ষে বাবা-মাকে কখনো কিছু কিনতে দেখিনি।সব সময় আমাকেই কিনে দিতো।
এসব ভাবতে ভাবতে আরো বেশি কান্না আসছিলো!
চোখ মুছে ছেলেটাকে দোকানের ভিতর নিয়ে গেলাম।ফ্রেন্ডকে বললাম,শার্টটা দিতে।তারপর ওকে নিয়ে পাশের মার্কেটে গিয়ে ওর জন্য একটা জামা আর ওর মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনলাম।তারপর আমার বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবী আর মায়ের জন্য একটা শাড়ী!
এগুলো নিয়ে হোটেল থেকে কিছু খাবার কিনে ওর বাড়ির দিকে যাই! যেমনটা ভেবেছিলাম,ছোট্ট একটা ঘর,বাবা শুয়ে আছে! ইফতারীর বেশী বাকী নেই।একটু পর ওর মা’ও আসে।তাদেরকে পুরো ঘটনাটা বলি।তারা তো তাদের ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছিলো।
আমি বিদায় নিয়ে চলে আসি,আসার সময় ঈদের দিন সুমনকে আমাদের বাসায় আসার জন্য বলি।
বাসায় ফিরে দেখি বাবা-মা বসে আছে ইফতারী নিয়ে।মা এগিয়ে এসে বলছে,
-বাবা,কেনাকাটা করেছো..?
একটু পর বাবা একটা প্যাকেট নিয়ে আসে।
আমাকে দিয়ে বলে “খুলে দেখ!”
খুলে দেখি,একটা মোবাইল ।যেটা আমি কিনতে চেয়েছিলাম।কিন্তু এত টাকা বাবা কোথায় পেলো।
মাকে জিজ্ঞেস করলাম,মা কিছু বলতে চাচ্ছে না।বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,বাবা বললো ”
তোর মায়ের একটা মাটির ব্যাংক ছিলো
তোর মোবাইল কেনার জন্য ভেঙে ফেলছে তোর মা।
কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না।মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিয়েছি।তারপর বাবার পা ধরে সকালের ব্যাপারটার জন্য ক্ষমা চাই।তারপর আমার ব্যাগ থেকে তাদের জন্য কেনা পাঞ্জাবী আর শাড়ীটা দেই।
তারা তো মাহ খুশি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিয়েছে।আজ সুমন আমায় শিখিয়ে দিয়েছে সুখে থাকার জন্য অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন হয়না।
যা আছে তানিয়ে সন্তুুষ্ট থেকে সুখে থাকা যায় এবং প্রত্যাশা যত কম হবে, পাওয়ার বেদনা ততো কম হবে।
একটু সেক্রিফাইস করে শেয়ার করলে
দেখা যাবে আমরা সবাই সুখি।
এটা গল্প হলেও কারো না কারো সাথে মিলে যায়।
এবারের ঈদে হাসি ফুটুক সবার মুখে ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত
বিষয়: #ঈদ #শপিং